বিশ্বজুড়ে জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম ৩৫০ ডলারের ওপরে বেড়েছে। গত শুক্রবার বিশ্ববাজারে সোনার দাম বেড়ে হয়েছে প্রতি আউন্স দুই হাজার ৪১৪ ডলার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সোনার দামের এ উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যাপক ক্রয়। বিশেষত অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ডলার ছেড়ে সোনায় ভরসা রাখতে চাইছে দেশগুলো। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা ক্রয় বাড়িয়েছে ব্যাপকভাবে। টানা ১৪ বছর সোনা ক্রয় অব্যাহত রেখেছে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো।

ফলে প্রশ্ন উঠেছে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে সোনা কি ডলারের বিকল্প হয়ে উঠেছে?

মার্কিন অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ : বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট, পাশাপাশি আমেরিকার অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, যুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার জেরে মার্কিন ডলারে আস্থা কমেছে বিনিয়োগকারীদের। তাঁরা নিরাপদ সঞ্চয় খুঁজছেন, সেই স্থানটি দখল করে নিয়েছে সোনা। বিশেষত বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেখানে বাণিজ্যের জন্য ডলারের বিপুল মজুদ রাখত, তারাই এখন ডলার ছেড়ে সোনা কিনছে। ফিন্যানশিয়াল টাইমসের বিশ্লেষক হ্যারি ডেম্পসির মতে, বিশ্বের আর্থিক পরিস্থিতি এখন যেদিকে যাচ্ছে, তাতে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সোনাকেই বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

ডলারে আস্থা কমছে : বিশ্বের সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ ডলারে হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ডলারের ওপর থেকে আস্থা কমছে। বিশ্ব রাজনীতির টালমাটাল অবস্থা, রাশিয়া-চীনের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে জড়িয়ে থাকা দেশগুলোও লেনদেনের ক্ষেত্রে বিকল্প খুঁজছে। পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিতে থাকা রাশিয়ার রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করায়। এই অবস্থায় অন্যান্য দেশও ভাবছে, তারাও রাশিয়ার মতো ঝামেলায় পড়তে পারে যেকোনো সময়। এ কারণে এসব দেশ দ্বিমুখী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, এসব দেশ স্থানীয় বা নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের পরিমাণ বাড়াচ্ছে এবং দ্বিতীয়ত সোনার মজুদ বাড়াচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মিলে ৪৫০.১ টন সোনা কিনেছিল। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৩৫.৭ টনে এবং ২০২৩ সালে দেশগুলোর সোনা কেনার পরিমাণ ছিল ১০৩৭ টন। সব মিলিয়ে বিগত বছরগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা কেনার নজিরবিহীন আকাঙ্ক্ষা ডলারের প্রতি আস্থাহীনতাই স্পষ্ট করছে।

২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মোট সোনা কিনেছে ২৯০ টন। সোনার মজুদ সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩০.১২ টন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাড়িয়েছে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২৭.০৬ টন, তৃতীয় সর্বোচ্চ ভারত বাড়িয়েছে ১৮.৫১ টন, কাজাখস্তান বাড়িয়েছে ১৬.৩৯ টন, সিঙ্গাপুর বাড়িয়েছে ৬.৫৭ টন।

চাহিদার কারণে দামও বাড়ছে : বিগত কয়েক বছরে সোনার চাহিদা বাড়ার কারণে দামও বেড়েছে সমানতালে। ১৯৮৮ সালে প্রতি আউন্স সোনার দাম ছিল ৪৩৭ ডলার, ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ২৬৮.৯৩ ডলারে অর্থাৎ এই সময় প্রতিবছর গড়ে সোনার দাম বেড়েছে ৩.৬১ শতাংশ হারে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে সোনার দাম বেড়ে হয় প্রতি আউন্স দুই হাজার ৪১৪ ডলার। এতে দেখা যায়, গত ছয় বছরে সোনার বার্ষিক দাম বেড়েছে গড়ে ৯.৭ শতাংশ করে।

সোনার রিজার্ভে শীর্ষ দেশগুলো : ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকের হিসাব অনুযায়ী, সোনার রিজার্ভের দিক থেকে বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সোনার রিজার্ভ আট হাজার ১৩৩.৪৬ টন, যা মোট রিজার্ভের ৭১.৩৩ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে জার্মানি, দেশটির সোনার রিজার্ভ তিন হাজার ৩৫২.৩১ টন, যা মোট রিজার্ভের ৭০.৫৬ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে ইতালি, দেশটির সোনার রিজার্ভ দুই হাজার ৪৫১.৮৪ টন, যা মোট রিজার্ভের ৬৭.৫৫ শতাংশ। চতুর্থ অবস্থানে ফ্রান্সের সোনার রিজার্ভ দুই হাজার ৪৩৬.৯১ টন, যা মোট রিজার্ভের ৬৮.৬১ শতাংশ। পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। দেশটির সোনার রিজার্ভ দুই হাজার ৩৩২.৭৪ টন, যা মোট রিজার্ভের ২৮.১৪ শতাংশ।

সূত্র : রয়টার্স, সিএনবিসি, ট্রেডিং ইকোনমিকস, ফোর্বস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *