আগামী বছরেই নিজেদের স্বর্ণ মজুদ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে ধনী দেশগুলোর ১৩ শতাংশ সেন্ট্রাল ব্যাংক। গত বছরে এ পরিকল্পনা ছিল মাত্র ৮ শতাংশের।
রিজার্ভে মার্কিন ডলারের অংশ কমিয়ে উদীয়মান অর্থনীতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ব্যাপক পরিমাণে স্বর্ণ কিনতে শুরু করেছিল আগেই – এবার যা অনুসরণ করছে উন্নত অর্থনীতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। এতে তাদের রিজার্ভে-ও স্বর্ণের অংশ বাড়বে বলে জানিয়েছে আর্থিকখাতের এসব নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
স্বর্ণশিল্পের প্রমোশনকারী একটি বৈশ্বিক জোট ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) বার্ষিক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপে অংশ নেওয়া বিশ্বের ধনী দেশগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারণা, বৈশ্বিকভাবে রিজার্ভ সম্পদের মধ্যে স্বর্ণের অংশ আগামী পাঁচ বছরে অনেকটা বাড়বে। গত বছরে এমন ধারণার কথা জানায় ধনী দেশগুলোর মাত্র ৩৮ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আগামী বছরেই নিজেদের স্বর্ণ মজুদ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে ধনী দেশগুলোর ১৩ শতাংশ সেন্ট্রাল ব্যাংক। গতবছরে এ পরিকল্পনা ছিল মাত্র ৮ শতাংশের। তবে গোল্ড কাউন্সিলের জরিপ শুরু হওয়ার পর থেকে তখন পর্যন্ত সেটিই ছিল সর্বোচ্চ।
স্বর্ণ কেনায় এগিয়ে রয়েছে উদীয়মান বাজার অর্থনীতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমূহ। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময় থেকেই তারাই হলো স্বর্ণের মূল ক্রেতা।
তবে বৈশ্বিক রিজার্ভে সামষ্টিকভাবে মার্কিন ডলারের আধিপত্য যে কমবে, ৫৬ শতাংশ ধনী দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা অনুমান করছে। আগের বছর এমন ধারণার কথা জানিয়েছিল উন্নত অর্থনীতির ৪৬ শতাংশ সেন্ট্রাল ব্যাংক। অপরদিকে, এমন মতপ্রকাশ করে, উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর ৬৪ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম অনেকটাই চড়া হওয়া সত্ত্বেও চলতি বছরে স্বর্ণের চাহিদা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ সম্পদে বহুমুখী করার উদ্যোগ এই চাহিদাকে ব্যাপকভাবে চাঙ্গা রেখেছে। একইসঙ্গে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের মুদ্রা ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, এরপর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও তাদের রিজার্ভে অন্যান্য মুদ্রা ও স্বর্ণের অংশ বাড়াচ্ছে। কমাচ্ছে ডলারের অংশ।
ডব্লিউজিসির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়ক প্রধান শাওকাই ফান বলেন, “এবছর আমরা আরো শক্তিশালী অভিসরণ লক্ষ করছি। উন্নত অর্থনীতিগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বলছে, বৈশ্বিক রিজার্ভে আরও বড় জায়গা দখল করবে স্বর্ণ, আর ডলারের ভাগ কমবে।”
তিনি বলেন, “শুধু যে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো এই প্রবণতাকে চালিত করেছে তাই-ই নয়, বরং অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা অর্থনীতিগুলোও এতে যোগ দিচ্ছে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ব্যবস্থাপকরা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের এই সমীক্ষায় মতামত দেন। এই কর্মকর্তারা সচরাচর রিজার্ভের বিষয়ে ততোটা প্রকাশ্য আলোচনা করেন না। সেদিক থেকে দেখলে, ডব্লিউজিসির জরিপটি তাদের চিন্তাধারার প্রতিফলনকেই তুলে ধরার বিরল কাজটি করে থাকে।
ডব্লিউজিসি পাঁচ বছর আগে প্রথম এই জরিপ শুরু করে। এরপর থেকে প্রতিবছরই তা করে আসছে। এবারের জরিপে উঠে এসেছে যে, রেকর্ড সংখ্যক কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী ১২ মাসে তাদের স্বর্ণ মজুত বাড়াতে চায়। জরিপে অংশ নেওয়া ২৯ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ ব্যবস্থাপক এমন পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন এবারে। তবে উদীয়মান অর্থনীতির ৪০ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণ মজুত বাড়ানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে।
স্বর্ণ দীর্ঘমেয়াদে মূল্য ধরে রাখার মতো সম্পদ। বিশেষত সংকটকালে এটি কাজে লাগানো যায়। একইসঙ্গে রিজার্ভে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রেও নির্ভরযোগ্য উপায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের পরিকল্পনার ব্যাখ্যা হিসেবে এসব কারণের কথা জানিয়েছে।
ডব্লিউজিসি’র তথ্যমতে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে রিজার্ভে এক হাজার টন করে স্বর্ণ যোগ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মস্কোর সাথে বাণিজ্যে মার্কিন ডলারে লেনদেনে বিধিনিষেধ রয়েছে ওয়াশিংটনের। এবিষয়টি ভারত, চীনসহ যেসব দেশের রাশিয়ার সাথে বড় অংকের বাণিজ্যিক লেনদেন রয়েছে– তাদেরকে স্বর্ণ কেনায় উৎসাহিত করেছে। কারণ স্বর্ণের বাজারমূল্য কোনো দেশের সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেধে দেয় না।
টানা দুই বছর ধরে রেকর্ড পরিমাণে স্বর্ণ ক্রয়ের ফলে– বহুমূল্য এই ধাতুর বৈশ্বিক বাজারমূল্য গত মাসেই প্রতি ট্রয় আউন্সে ২ হাজার ৪৫০ ডলারে পৌঁছায়। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতাও প্রভাবিত করছে স্বর্ণের বাজারদরকে। গত বছরের ৭ অক্টোবরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যা ৪২ শতাংশ বেড়েছিল গত মাস পর্যন্ত।
অন্যদিকে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে (ফরেক্স রিজার্ভে) স্বর্ণের অংশ গত বছর প্রায় ৫৫ শতাংশে নেমে আসে, যা ২০০০ সালে ছিল ৭০ শতাংশ। এটি ডলারের বিনিময় দর বাড়ার প্রভাবকে অনেকটাই লঘু করেছে বলে চলতি মাসে এক গবেষণার বরাত দিয়ে জানায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।