টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২৭ সালের মধ্যে ছোট-বড় সব ব্যবসার ৭৫ শতাংশ লেনদেন অনলাইন তথা ক্যাশলেস করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এ উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে গত বছর থেকে বাংলা কিউআরের মাধ্যমে ক্যাশলেস লেনদেন সেবার ব্যয় ব্যাংকের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) খাতে দেখানো যাচ্ছে।

কিউআর কোড কী
বাংলা কিউআর হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থাপিত আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তির পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত যেকোনও ব্যাংক, এমএফএসের গ্রাহক কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারে বলেছে, বাংলা কিউআরের মাধ্যমে সম্পাদিত সব লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত হারে মার্চেন্ট ডিসকাউন্ট রেট ও ইন্টার ব্যাংক রিইমবার্সমেন্ট মাশুল-সংক্রান্ত খরচ সিএসআর হিসেবে দেখানো যাবে। ক্যাশলেস বাংলাদেশ উদ্যোগের আওতায় ক্যাম্পেইন-সংক্রান্ত যাবতীয় প্রচারণা, কোরবানির হাটের যাবতীয় লেনদেন ও অবকাঠামোসংশ্লিষ্ট ব্যয়গুলো এবং বাংলা কিউআরের প্রচার ও প্রসারে গৃহীত প্রচারণাসংক্রান্ত ব্যয়গুলোও থাকবে। অবশ্য ক্যাশলেস বাংলাদেশ উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের যাতায়াত ভাতা, থাকা–খাওয়া, হোটেল বিল ও যাতায়াত ভাতা হিসেবে গণ্য ব্যয়গুলো সিএসআর ব্যয় হিসেবে দেখানো যাবে না।

প্রসঙ্গত, ক্যাশলেস বাংলাদেশ তথা নগদবিহীন লেনদেনের দেশ গড়ার অংশ হিসেবে বাংলা কিউআর কোডের প্রচলন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে কোডভিত্তিক লেনদেন করা যাচ্ছে।

সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন, বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-৪১ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেমে আনয়ন করে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সব লেনদেনের ৩০ শতাংশ এবং ২০৩১ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ ক্যাশলেস করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রান্তিক ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামোর আওতায় আনার জন্য বাংলা কিউআর কোড চালু করা হয়েছে।

২০৩১ সালে শতভাগ ক্যাশলেস লেনদেন
ইতোমধ্যে সাধারণ গ্রাহকের মধ্যে অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ডিজিটাল লেনদেনের প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্পের সঙ্গে সংগতি রেখে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সব লেনদেনের ৩০ শতাংশ এবং ২০৩১ সালের মধ্যে শতভাগ অনলাইন বা ক্যাশলেস লেনদেনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এদিকে ক্যাশলেস লেনদেনের সুবিধা পেতে সব দোকানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর কথা ভাবছে এনবিআর। এরই অংশ হিসেবে আগামী অর্থবছরে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই লক্ষ্য অর্জনে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসে জোর দেওয়ার কথা ভাবছে সরকারি এই সংস্থা। শুধু তা-ই নয়, রাজস্ব আয় বাড়াতে ক্যাশলেস লেনদেনকে উৎসাহ দিচ্ছে এনবিআর।

দিতে হবে অতিরিক্ত ২.৫০ শতাংশ কর
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো যদি নগদবিহীন বা ক্যাশলেস লেনদেনব্যবস্থা অবলম্বন না করে, তাহলে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত ২ দশমিক ৫০ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হতে পারে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে তার বাজেট উপস্থাপনে প্রস্তাবটি অন্তর্ভুক্ত করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

তবে পাবলিকলি ট্রেড করা কোম্পানিগুলো যদি নগদবিহীন লেনদেনের শর্ত মেনে চলে, অর্থাৎ নগদ লেনদেন বছরে ৩৬ লাখ টাকার মধ্যে বজায় রাখে, তাহলে আগের হারেই কর দিতে পারবে কোম্পানিগুলো।

শর্তপূরণ সাপেক্ষে কমবে কর হার
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, অতালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানি বর্তমানে সাড়ে ২৭ শতাংশ করপোরেট কর দেয়, সেগুলো যদি নগদবিহীন লেনদেনের শর্ত মেনে চলে, তাহলে তাদের এই হার আড়াই শতাংশ কমানো হবে। একই সুবিধা এক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ শর্তপূরণ সাপেক্ষে এগুলোর করপোরেট করের হার আড়াই শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হবে।

নগদবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে ১০টি ব্যাংক, ৩টি মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবা এবং তিনটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেমকে এ কাজে প্রাথমিকভাবে যুক্ত করা হয়েছে। ‘সর্বজনীন পরিশোধ সেবায় নিশ্চিত হবে স্মার্ট বাংলাদেশ’ স্লোগান সামনে রেখে প্রথমে মতিঝিল এলাকায় চা-দোকান, মুদি দোকান, হোটেল, মুচিসহ ভাসমান বিক্রেতাদের কিউআর কোড সুবিধা দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই বিভিন্ন বিভাগীয় শহরকে এর আওতায় আনা হবে। পর্যায়ক্রমে এই সেবা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।

২০২৭ সালের মধ্যে দেশের ৭৫ শতাংশই লেনদেন ক্যাশলেস হবে বলে আশা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

যা বলছে পরিসংখ্যান
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মোবাইল ব্যাংকিং বা এমএফএসের মাধ্যমে এক লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হলেও ক্যাশলেস লেনদেন হয়েছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। এমএফএস দিয়ে কেনাকাটা, মোবাইল রিচার্জ আর পরিষেবা বিল পরিশোধ হচ্ছে কেবল ক্যাশলেসে। একইভাবে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয় প্রায় ৩৯ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকৃত ক্যাশলেস তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা। কারণ, কার্ড দিয়ে এটিএম বুথ থেকে নগদ টাকা বেশি উত্তোলন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কার্ডের মাধ্যমে পয়েন্ট অব সেলস ও ই-কমার্সে যে কেনাকাটা হয়, তা ক্যাশলেস লেনদেন।

সরকারি বেতন-ভাতা, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন ইলেকট্রিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে দেওয়া হয়, যা একপ্রকার ক্যাশলেস লেনদেন। প্রতি মাসে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে লেনদেন প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি ও সিইও মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এখন মোবাইল অ্যাপ দিয়েই কেনাকাটা, বিল পেমেন্ট, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট এমন নানামুখী ডিজিটাল লেনদেন করা সম্ভব হচ্ছে।

নগদ টাকা বহনে কমেছে ঝামেলা
ক্যাশলেস সমাজে মানুষ এখন কার্ডের পরিবর্তে মোবাইল অ্যাপ দিয়ে কিউআর কোড ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন একটি অ্যাপভিত্তিক বহুমুখী ব্যাংকিং সেবা। বর্তমানে গ্রাহক এই অ্যাপ ব্যবহার করে কেনাকাটা থেকে শুরু করে পরিষেবা বিল, ক্রেডিট কার্ড বিল, বাস ও ট্রেনের টিকিট কাটার মতো কাজ অনায়াসেই সেরে নিচ্ছেন।

গত বছরের শুরুতে প্রায় ১২০০ মার্চেন্ট নিয়ে রাজধানীর মতিঝিলে এই ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগটির যাত্রা শুরু হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, পণ্য বা সেবা মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে নগদ অর্থ, কার্ড বা চেক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নগদ অর্থে পরিশোধ ঝুঁকিপূর্ণ, চেকে পরিশোধ সময়সাপেক্ষ ও জটিল। অন্যদিকে কার্ড ব্যবহারের জন্য ব্যাংক বা এমএফএস-গুলোকে ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামো বিনির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। ফলে কার্ডে মূল্য পরিশোধব্যবস্থা মার্চেন্টদের জন্য ব্যয়বহুল। ছোট মার্চেন্টের (যেমন: ডাব বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, মুচি ইত্যাদি) পক্ষে এ ব্যয় বহন করা সম্ভব নয় বিধায় প্রান্তিক পর্যায়ে ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জিত হয়নি। ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসারে পৃথিবীব্যাপী লো-কস্ট সলিউশন প্রচলনের তাগিদ রয়েছে।

কুইক রেসপন্স (কিউআর) ডিজিটাল পেমেন্ট এমনি একটি লো-কস্ট সলিউশন। বাংলা কিউআর-এ অংশগ্রহণকারী যে কোনও ব্যাংক ও এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী গ্রাহক যে কোনও ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী মার্চেন্টকে পণ্য বা সেবামূল্য পরিশোধ করতে পারবেন।

কিউআর কোড কেবল একটি প্রিন্টেড ছবি হওয়ায় এই পরিশোধব্যবস্থায় মার্চেন্টের অংশগ্রহণের খরচ নেই। তাই এ পরিশোধব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *