।আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দোহাই দিয়ে ডলারের দাম বাড়ছেই। টাকার বিপরীতে গেল আট মাসে ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ডলারের দাম। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রাও মূল্য হারিয়েছে ডলারের বিপরীতে। অন্যতম শক্তিশালী মুদ্রা ইউরো এখন প্রায় ডলারের সমান দামে বিনিময় চলছে। কিন্তু ডলার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? সম্প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় অতীতের মতো আরও একবার সামনে এসেছে এ প্রশ্ন।

তিনি আরও বলেন, ‘ডলারের এ চাহিদা সৃষ্টি করা হয়েছে বিশ্বের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানিপণ্য তেলের মাধ্যমে। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব ও অন্যান্য ওপেকভুক্ত তেল রফতানিকারক দেশগুলোকে বাধ্য করেছে শুধু ডলারের বিনিময়ে তেল বিক্রি করতে। এতে একদিকে আমেরিকা নিজের ছাপানো কাগজের “ডলার” দিয়ে তেল কেনার সুযোগ পায়, অপরদিকে অন্য রাষ্ট্রগুলো তেল কিনতে গিয়ে ডলারের শরণাপন্ন হয়। ফলে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে এ মুদ্রার অবস্থান শক্তিশালী হতে থাকে। স্বর্ণনির্ভরতা কাটিয়ে আমেরিকার মুদ্রা ডলার চিহ্নিত হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মুদ্রা হিসেবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে ডলারের মাধ্যমে তেল কেনাবেচা। সৌদি আরবের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলার ব্যবহারে বাধ্য করে সৌদিকে। তখন থেকে ডলার ‘পেট্রো ডলার’ হিসেবে বিবেচিত।

উল্লেখ্য, ডলারের এ ক্ষমতা কমাতে ফ্রান্স ও জার্মানি ১৯৯৯ সালে চালু করে ইউরো মুদ্রা। ওই সময় ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ঘোষণা দেন, ‘তেল আর ডলারে নয়, ইউরোতে বিক্রি করবে ইরাক।’ এরপর ২০০০ সাল থেকে ইরাক ইউরোতে তেল বিক্রি শুরু করে। ডলারের পতন আশঙ্কায় ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে। তারা সাদ্দাম সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন সরকার বসায় এবং ফের ডলারে তেল বিক্রি শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের স্বর্ণ সংরক্ষণ করে। ১৯৭১ সালে কিছু দেশ তাদের ডলার মজুদের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বর্ণ ফেরত চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ‘চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’ ১৯৪৫ সালের ‘ব্রেটেন উড কনফারেন্সে’র এ চুক্তি লঙ্ঘন করে যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তিভঙ্গের ফলে ডলারের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাওয়ার কথা থাকলেও ক্ষমতা দিয়ে ডলারকে বিশ্ব বাণিজ্যের মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দেশটি।

সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র সুইফট থেকে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করে। এর ফলে রাশিয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তখন চীনের সঙ্গে মিলে রাশিয়া নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি রাশিয়া থেকে গ্যাস, তেল কেনা দেশগুলোকে শর্ত দেয় রাশিয়ান মুদ্রা ‘রুবলে’ মূল্য পরিশোধ করার জন্য। ইউরোপের দেশগুলো রুবলে মূল্য পরিশোধ করা শুরু করায় দাম বাড়ে রুবলের। ডলারের আধিপত্য কমাতে কয়েকটি দেশ এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে। মার্কিন ব্যাংকিং-ব্যবস্থার তুলনামূলক নির্ভরযোগ্যতার কারণে অনেক রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ’ ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে জমা রাখতে থাকে। এভাবে বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর অভিযোগ, ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাণিজ্যে ডলার ব্যবহার করতে পারে না ইরান। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়াকেও একই নিষেধাজ্ঞা দেয় আমেরিকা। এর ফলে এ দেশগুলো ডলারের একাধিপত্যের বিরোধী। রুশ রাষ্ট্রপতি ভøাদিমির পুতিনের ভাষ্য, ‘আমরা ডলারকে ছেড়ে যাচ্ছি না, ডলারই আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে।’ এ ছাড়া আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা সাত বিলিয়ন ডলার বাজেয়াপ্ত করায় প্রশ্নের মুখে পড়ে আমেরিকা। এ পরিস্থিতিতে অনেক অর্থনীতিবিদ এমন একটি মুদ্রার আশা করছেন, যা মার্কিন ডলারের বিপরীতে বৈশি^^ক মুদ্রা হিসেবে প্রতিস্থাপন হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, ‘গেল দশকে মার্কিন ডলারের আধিপত্য কিছুটা খর্ব হয়েছে। সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে ইউরো, চীনা ইউয়ান ও জাপানি ইয়েনের কথা বলা হচ্ছে। কেউ কেউ কাগুজে মুদ্রার পরিবর্তে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বৈশি^ক মুদ্রা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করছেন। তবে সবকিছুই নির্ধারিত হবে দেশগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে। আমেরিকার বিরুদ্ধে কিছু করতে হলে অবশ্যই একমত হয়ে কাজ করতে হবে।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে একাধিপত্য ছিল তা এখন আর নেই। চীন ও জার্মানি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া ধীরে ধীরে মার্কিন ডলারের বিকল্প মুদ্রা প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ ছাড়া ২০০৪ সালে ইরান ইউরোতে তেল বিক্রির ঘোষণা দেয়। ওপেকভুক্ত আরও কিছু দেশ এখন ইউরোতে তেল বিক্রির উদ্যোগ নিচ্ছে। ইউরোপ, চীন, ভারত, জাপানসহ অনেকেই ইউরোতে তেল কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি সৌদি আরব চীনের কাছে ইউয়ানে তেল বিক্রি করবে বলে জানিয়েছে। এতে ডলারের বিপরীতে চীনের মুদ্রা শক্তিশালী হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের বিকল্পও হয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *