সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে। এর কারণ নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন দেশটিতে কর্মরত কনস্যুলেট জেনারেল অব বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেন
দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে ছিল। কিন্তু এখন আরব আমিরাত প্রথম স্থানে রয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অনেক আলোচনা-সমালোচনা। আবার অনেকে অনেক কারণের কথা বলেন। সবকিছুকে ছাপিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
যারা হুন্ডি করে তাদের একটি মেকানিজম আছে। তা হচ্ছে মাসের শুরুতে প্রবাসীরা যখন বেতন পান তখন হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ক্যাম্পগুলোতে গিয়ে বোঝায় যে তারা এমএফএস (মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা পাঠায়। কিন্তু ওই এমএফএস প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুমোদিত নয়। এটা এ কারণে বলা হয় যে যিনি দেশে টাকাটা গ্রহণ করেন তিনি যেন ওই এমএফএসের মাধ্যমে করেন। ফলে দেশের মানুষ ও প্রবাসীরা ধরে নেয়, এ টাকাটা এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে যাচ্ছে।
এখন অনুমোদিত এমএফএস প্রতিষ্ঠানের কথা বলে কারা এ কাজ করে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। আমরা সচেতনতামূলক যেসব প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি তার মধ্যে একটি হলো আমরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে বুঝিয়েছি, এটি আসলে হুন্ডি, যা বাংলাদেশের আইনে একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। অনেক সময় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। প্রবাসীদের বলা হতো, আপনারা বাইরের দেশে অনেক কষ্ট করে এসেছেন, টাকা উপার্জন করেছেন কিন্তু পাঠানোর সময় অবৈধ উপায়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। আপনি যদি ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠান তাহলে আপনি একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। পাশাপাশি সরকার ঘোষিত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা পেতে পারেন। ফলে তাদের কাছ থেকে একটা পজিটিভ সাড়া পেয়েছি। নিয়োগদাতা যারা, তাদেরকে এসব বিষয়ে অবহিত করেছি। যেসব এজেন্ট ক্যাম্পগুলোয় গিয়ে হুন্ডির টাকা সংগ্রহ করে তাদেরকে বলেছি হুন্ডির এজেন্ট টাকা সংগ্রহ করতে এলে যেন আমাদের অবহিত করে৷ এ কার্যক্রমের একটা ডিমোনেস্ট্রেটিভ ইফেক্ট রয়েছে। তখন হুন্ডির এজেন্টদের মধ্যে একটা ভয় সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তারা তাদের কার্যক্রম কমিয়ে দিয়েছে। ক্যাম্পগুলোয় আসতে ভয় পাওয়া শুরু করেছে, যদি গ্রেফতার করা হয়। আমরা পুলিশের সহায়তায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করতেও সক্ষম হই। এছাড়া কিছু ছোট দোকানেও এমএফএসের নাম করে হুন্ডির ব্যবসা করা হয়। আমরা এ দোকানগুলো চিহ্নিত করি।
সাধারণ কর্মীরা কী চায়? আমার অবজারভেশনে আমি দেখেছি, তারা যে অর্থকড়ি উপার্জন করে তাতে তারা খুশি থাকে কিন্তু তারা সম্মান চায়। তাদের অভিযোগ তারা যেখানেই যায় যথাযথ সম্মান পায় না। তারা কনস্যুলেট গেলেও যথাযথ সম্মান পায় না। তখন আরেকটা বিকল্প রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড চালু করা হলো। এ অ্যাওয়ার্ড সাধারণত তাদের দেয়া হয় যারা রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে শীর্ষে অবস্থান করেন। আরব আমিরাতে বর্তমানে ৮০ জন সিআইপি আছেন। প্রত্যেক বছর ৩০-৪০ জন করে সিআইপি বাড়ে। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। এই যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ১০ লাখ বা ১২ লাখ জনশক্তি আছে তাদের কি আমরা কোনোভাবে সম্মান জানাই? তাদের সম্মান জানানোর জন্য বিকল্প রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড প্রদানের মাধ্যমে তাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
যারা সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স পাঠায় তাদের বেছে নিয়ে ২০২২ সাল থেকে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে অ্যাওয়ার্ড দেয়া শুরু করি, যা ব্যাপক সাড়া জাগায়। এর ফলে যারা দীর্ঘদিন তেমন সম্মান পেত না তারা মন্ত্রীর হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করছে। এ সম্মাননার বড় একটি ইমপেক্টের উদাহরণ হলো একজন কর্মী ছুটিতে দেশে গিয়ে যখন দেখে তাকে গ্রহণ করার জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে, তখন বুঝতে পারেন বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠানোর ফলে তিনি সম্মানিত হচ্ছেন। ২০২১ সালের আগ পর্যন্ত প্রবাসীরা ৬০ ভাগ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে এবং ৪০ ভাগ অর্থ বৈধভাবে প্রেরণ করত। এখন তা পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে অ্যাপসভিত্তিক রেমিট্যান্স পাঠানোর নিয়মও প্রচলিত হয়েছে। এখন মানুষ ঘরে বসেই বৈধভাবে টাকা পাঠাতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে বর্তমানে ৬০ ভাগ রেমিট্যান্স বৈধভাবে পাঠানো হয়। ফলে এখনো ৪০ শতাংশ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে যাচ্ছে।
ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা পোহাতে হয়। এসব সমাধান করতে আপনারা বাংলাদেশ সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেছেন কি?
আমি মনে করি, হুন্ডি ব্যবস্থা একেবারে শেষ করা সম্ভব নয়, তবে কমিয়ে আনা সম্ভব। বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে তা ৮০ ভাগ ব্যাংকে ও ২০ ভাগ হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে আসা সম্ভব। যেসব কারণে হুন্ডি হয়, রেটের একটা ব্যাপার আছে। ২ দশমিক ৫ শতাংশ ইনসেনটিভ কিন্তু সাধারণ কর্মীরা বুঝবে কিনা। আমরা যখন সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করেছিলাম তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় দেখেছি বেশির ভাগই জানে না ইনসেনটিভ কীভাবে পাওয়া যায়। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি দল, জনতা ব্যাংক এবং রেমিট্যান্স নিয়ে কাজ করা ৩০টি এক্সচেঞ্জ হাউজকে সঙ্গে নিয়ে প্রোগ্রাম করেছি। আমরা প্রথম শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি হুন্ডি কেন হয়?
আগামীতে আপনারা কী কী করতে চান? এ নিয়ে আপনাদের নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা আছে?
কনস্যুলেটের মাধ্যমে আমাদের কিছু কর্মপরিকল্পনা আছে। প্রবাসী কর্মীদের যে ডাটাবেজ তৈরি করতে চাই তা দিয়ে আমরা চিহ্নিত করতে পারব রেগুলার রেমিট্যান্স দেয় কিনা। আমাদের আরেকটি মডেল আছে। আগেও আমি বলেছি প্রবাসীদের চাওয়া-পাওয়া সামান্য। তারা যখন সেবার জন্য বাংলাদেশী কনস্যুলেটে আসবে তখন তারা যেন সম্মানের সঙ্গে সেবাটা পায়। এজন্য কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আরেকটা হচ্ছে সেবা বিকেন্দ্রীকরণ মডেল। দূর-দূরান্তে যেসব প্রদেশ আছে সেখানে সেবা নিতে এলে তাদের অর্থ ও ছুটির প্রয়োজন হয়। এজন্য তাদের অনেক বেগ পোহাতে হয়। এসব বিবেচনা করে প্রত্যেকটা অঞ্চলে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে বাংলাদেশীরা আছে সেখানে আমরা কনস্যুলার আউটরিচ প্রোগ্রামের মাধ্যমে সেবা দেই। ফলে তাদের কষ্ট করে এতদূর আসতে হয় না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমরা যত তাদের ট্রাভেল কমাতে পারব, তারা তত স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা গ্রহণ করতে পারবে।