ইতালির ‘ন্যু লস্তা’ (ওয়ার্ক পারমিট) পেয়ে ২০২৩ সালের আগস্টে ভিসার জন্য ভিএফএস গ্লোবালে আবেদন করেছিলেন ভোলার বাসিন্দা মো. রুবেল। এরপর দীর্ঘ ১০ মাস গড়িয়েছে।
এখনো ভিসা পাননি তিনি। পাবেন কি না, সেটাও জানেন না। আক্ষেপ ঝরে রুবেলের কণ্ঠে, ‘এখন আমার অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই। অপেক্ষা করতে করতে উপার্জনের জন্য ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন এখন ফিকে লাগে। ’
গত মঙ্গলবার (২১ মে) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর গুলশান-১ নম্বরের নাফি টাওয়ারে অবস্থিত ভিএফএস গ্লোবালে নিজের আবেদনের খোঁজ নিতে এসেছিলেন এই ভিসাপ্রত্যাশী। প্রতিষ্ঠানটির সামনে দুঃখভরা মনে বাংলানিউজকে তিনি বললেন মাসের পর মাস অপেক্ষা আর হতাশার কথা। এদিনও রুবেল কোনো তথ্য পাননি। হতাশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন বাড়ি।
রুবেল বলছিলেন, ১০ মাস চলে গেছে, কিন্তু এখনো মেসেজ পাইনি। অথচ নিয়মে আছে- ভিএফএস গ্লোবাল একজনের পাসপোর্ট সর্বোচ্চ ৯০ দিন রাখতে পারে। সব ঠিক থাকলে ৯০ দিনে ভিসা দেবে ইতালি দূতাবাস, আর যদি ডকুমেন্টসে কোনো ঝামেলা থাকে, ভিসা আবেদন রিজেক্ট হলেও ৯০ দিনের মধ্যেই পাসপোর্ট ফেরত দেবে। কিন্তু ১০ মাসেও (৩০০ দিন) আমি আমার পাসপোর্ট হাতে পাইনি।
তিনি বলেন, আমার ‘ন্যু লস্তা’র মেয়াদ ছিল ছয় মাস। ইতালিতে ন্যু লস্তা পাওয়ার পর আমি সব সত্য ডকুমেন্টস যোগ করে ভিসার আবেদন করেছিলাম। এর জন্য এজেন্সিকে আমি ১১ লাখ টাকা দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ১০ মাসেও আমি মেসেজ পাইনি। এখন আমার সব কিছু শেষ, তবু পাসপোর্ট আটকা পড়ে আছে।
শুধু রুবেল নয়, তার মতো অসংখ্য ভিসাপ্রত্যাশী আবেদন করে দীর্ঘ সময় পরও ফেরত পাচ্ছেন না তাদের পাসপোর্ট। বৈধভাবে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে যারা ইতালি যেতে চান, তারাই ভিএফএস গ্লোবালের দীর্ঘসূত্রতায় আটকে যাচ্ছেন। এই কারণে অনেকে অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্নের দেশ ইতালিতে। এতে সাগরে নৌযানডুবিসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ঘটছে বহু মৃত্যু।
২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশে ইতালি দূতাবাস ভিএফএস গ্লোবালের সঙ্গে ভিসা প্রদানসহ যাবতীয় সেবা নির্দিষ্ট ফি-র বিপরীতে সম্পাদনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। বাংলাদেশসহ ১৪৭টি দেশে ভিসা প্রক্রিয়ার কাজ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
মঙ্গলবার সকালে গুলশান-১ নম্বর এলাকার সাউথ অ্যাভিনিউয়ের নাফি টাওয়ারে অবস্থিত ভিএফএস গ্লোবালের সামনে গিয়ে দেখা যায়, এই ভবনের প্রবেশের সামনে সড়কে অপেক্ষায় অসংখ্য ভিসাপ্রত্যাশী। ফুটপাত ধরে অনেকেই বসে আছেন। আবার অনেকেই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। ফটকে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তাকর্মী। ভিসার জন্য আবেদন করতে অনেকেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছেন। নিরাপত্তাকর্মী তাদের কাগজ দেখেই ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন। আর যারা কোনো এজেন্সি বা দালালের মাধ্যমে ভিসার আবেদন করেছেন তারাও প্রতিষ্ঠানটির সামনে বা দূরে অবস্থান করে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
ঢাকার সাভারের বাসিন্দা ভুক্তভোগী সাগর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, গত ২৪ আগস্ট আমি জমাদার ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ভিএফএস গ্লোবালে ভিসার জন্য আবেদন করেছি। এই এজেন্সি আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাইয়ে দেবে বলে এক লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু ১০ মাসেও আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাইনি। এখন এজেন্সি বলছে, তাদের তিন লাখ টাকা দিলে তারা আমার ভিসা পাইয়ে দেবে। এখন ভিসা পেলেও আমার ন্যু লস্তার মেয়াদ তো শেষ আরও চার মাস আগেই।
তিনি বলেন, আমি সাভার থেকে এ পর্যন্ত ১৫ দিন ভিসার খোঁজ নিতে ভিএফএস গ্লোবালে এসেছি। তাদের কাছে খোঁজ নিতে গেলে বলে, মেসেজ পেলে আপনি আসবেন পাসপোর্ট নিতে। এর বাইরে আমাদের হাতে কিছু নেই। এখন আমি কী করবো?
সাগর হোসেন আরও বলেন, ইতালির ভিসা আবেদনে ন্যু লস্তার সঙ্গে আমি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর ডকুমেন্টসও জমা দিয়েছি। কোম্পানি ঠিক থাকলে আমার ন্যু লস্তা বৈধ থাকলে, আমি ভিসা পাবো। আর যদি না পাই তাও তো ৯০ দিনের মধ্যে আমার পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটাও পাই না।
‘ভিসা পেতে দীর্ঘসূত্রতা বৈধ পথে অভিবাসনের বড় অন্তরায়’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, আমরা দেখছি যারা ইতালিতে যেতে চাচ্ছেন, তাদের যাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। যারা অনিয়মের পথ ধরে যাচ্ছেন তারা কিন্তু ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে দালালকে অর্থ দিয়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু যারা বৈধভাবে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে ইতালি যেতে চান তাদের ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যাচ্ছে এটাই বৈধ পথের অভিবাসনের একটা বড় অন্তরায়। এই দীর্ঘসূত্রতার জন্য অনেক সময় বৈধ পথে যাওয়া ব্যক্তিদের ওয়ার্ক পারমিটের সময়টা পার হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, যদি এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে যে, লাখ লাখ টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে সহজে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু নিজে কাজ করলে হাজার বার চেষ্টায়ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে অবশ্যই সরকারকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার চাইলে অবশ্যই এর প্রতিকার আসবে।
তিনি বলেন, ইতালিয়ান আইন হচ্ছে, ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় ৯০ দিন, ফ্যামিলি রিইউনিয়ন ভিসায় ৩০ দিন এবং অটোনুম ওয়ার্ক ভিসায় ১২০ দিনের বেশি পাসপোর্ট আটকে রাখার কোনো সুযোগ নেই অ্যাম্বাসির।