দুবাইয়ে থাকা অফশোর সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছেন বাংলাদেশীরা। এজন্য সেখান থেকে প্রপার্টি কেনাবেচার ওয়েবসাইটগুলোয় বিজ্ঞাপনও দেয়া হচ্ছে বলে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে উঠে এসেছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলকে (সিআইসি) বিষয়টি অবহিত করেছে বিএফআইইউ। এ বিষয়ে এনবিআরকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শও দিয়েছে সংস্থাটি।
এনবিআরের একাধিক সূত্র বণিক বার্তাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশে থাকা অপ্রদর্শিত সম্পদ ঝুঁকিতে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় সেগুলো বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে। আবার অনেকেই আয়কর নথিতে এসব সম্পদ অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এনবিআরের সঙ্গে যোগাযোগও করছেন।
দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের সম্পদ বিক্রি করে দেয়ার বিষয়টিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিএফআইইউ-প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে-বিদেশে থাকা বাংলাদেশীদের অপ্রদর্শিত সম্পদ অনুসন্ধানে আমাদের একটি জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম কাজ করছে। দেশে থাকা অনেক সম্পদ আমরা এরই মধ্যে তদন্তের আওতায় নিয়ে এসেছি। পর্যায়ক্রমে বিদেশে থাকা সম্পদও তদন্তের আওতায় আনা হবে। আমাদের কার্যক্রম চলছে।
বাংলাদেশের আয়কর আইনে নিবাসী বাংলাদেশী করদাতার বিদেশে থাকা সম্পদ আয়কর নথিতে প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক। আইনে কোনো বাংলাদেশীর এ ধরনের কোনো সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলে তা নিয়ে দেশে-বিদেশে অনুসন্ধান চালানো এবং সমপরিমাণ অর্থ জরিমানার বিধান রয়েছে।
দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের অপ্রদর্শিত সম্পদ রয়েছে এমন তথ্য পেয়ে গত জানুয়ারিতে আরব আমিরাত সফর করে সিআইসির দুটি দল। আরব আমিরাত সফর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের কাজ চলমান। তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। আমরা তদন্ত শেষ করে বিস্তারিত জানাব।’
সংস্থাটির কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, দুবাইয়ে অনুসন্ধান করে বাংলাদেশীদের বেশকিছু সম্পদ শনাক্ত করা হয়েছে। তদন্তকালে তারা জানতে পেরেছেন, শুধু দুবাই নয়, এসব ব্যক্তির যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশেও সম্পদ রয়েছে।
দুবাইয়ে বাংলাদেশীরা তাদের অপ্রদর্শিত সম্পদ কেন বিক্রি করে দিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তারা নিজেদের নিরাপদ রাখতে এসব সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছেন। তবে বিক্রি করেও লাভ হবে না। হোল্ডিং নম্বর তো আছেই। আয়কর দিতেই হবে। আমরা করবর্ষ ধরে আয়কর আদায় করে নেবে। বিক্রি করলেও রিটার্নে ঘোষণা দিতে হবে। লাভের ওপর কর দিতে হবে। এরই মধ্যে কেউ কেউ আসছেন। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। দেশে থাকা তাদের প্রতিনিধিরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। অনেকেই ঝামেলা এড়াতে চান। সেজন্য তারা আয়কর দিয়ে এসব সম্পদ কর ফাইলে প্রদর্শন করতে চান। আরব আমিরাত সফরের উদ্দেশ্য ছিল এটা জানানো যে টাকা পাচার করে লাভ নেই। ধরা খেতে হবে।’
বিদেশে অপ্রদর্শিত সম্পদ গড়ে তোলা ব্যক্তিদের কাছ থেকে শুধু আয়কর আদায় নয়, তাদের মানি লন্ডারিং সম্পৃক্ত অপরাধেরও তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন উইংয়ের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখানে তো মানি লন্ডারিংয়ের উপাদানও রয়েছে। বিদেশে তারা বৈধ পথে সম্পদ অর্জন করেছেন, নাকি মানি লন্ডারিং করে অর্জন করেছেন; সে বিষয়েও তো তদন্ত করতে হবে। মানি লন্ডারিং হলে এসব সম্পদ তো বাজেয়াপ্তযোগ্য, তার আগে ক্রোক ও ফ্রিজ করতে হবে। তারপর বিক্রি করে আয়কর আদায়ের সময় আসবে। কিন্তু তার আগেই যদি এসব সম্পদের মালিকানা হস্তান্তর হয়ে যায়, তাহলে তো আরেকটা আইনি লড়াই তৈরি হবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাইয়ে বিপুল পরিমাণ অফশোর সম্পদ গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশীরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিফোরএডিএস) সংকলিত তথ্য অনুযায়ী, দুবাইয়ে ৪৬১ বাংলাদেশীর নামে ৯২৯টি নিবন্ধিত সম্পত্তি রয়েছে, যেগুলোর বাজারমূল্য প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পত্তির দাম আরো বেশি হতে পারে।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাত গোল্ডেন ভিসা সুবিধা চালু করার পর বাংলাদেশীদের দুবাইয়ে প্রপার্টি ক্রয়ের মাত্রা হু হু করে বাড়তে থাকে। বিত্তবান বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে এ ভিসা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থসম্পত্তির মালিকানা থাকলেই এ ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। শর্ত সহজীকরণের পাশাপাশি ভিসা প্রক্রিয়ার জটিলতাগুলোও দূর করা হয়েছে। দেশের ধনীদের অনেকেই ইউএইর দেয়া এ সুযোগ লুফে নিয়েছেন।
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ পাচার হয়েছে, সেটা ফিরিয়ে আনা কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ হলেও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ কাজে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি বিদেশী বিশেষজ্ঞদেরও সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
তবে দুবাইয়ে বাংলাদেশীরা অপ্রদর্শিত সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছেন, এমন তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা নতুন ইস্যু। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করব।’ প্রেম নিয়ে ক্যাপশন
মোটিভেশনাল উক্তি