নরসিংদীর রোমেল মিয়াকে লিবিয়ার একটি কার্পেট কোম্পানিতে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি দেওয়ার টোপ দেয় মানব পাচারকারী চক্র। দেশটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুপক্ষের মধ্যে চুক্তি হয় ৪ লাখ টাকার। সে অনুযায়ী দালালদের হাতে গত ৬ মার্চ ২ লাখ টাকা তুলে দেন রোমেল।

লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর বাকি টাকা পরিশোধের শর্তে ১ লাখ ২৪ হাজার টাকার সমপরিমাণ ডলার নিয়ে রহমতউল্লাহ ও বিল্লাল মিয়া নামে দুই ব্যক্তির সঙ্গে দেশটির উদ্দেশে রওনা হন তিনি।

কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পরপরই রোমেলকে জিম্মি করে মানব পাচারকারী চক্র। দেশে থাকা তার পরিবারের সদস্যদের কাছে দাবি করা হয় ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ। না দিলে নির্যাতন করে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।

রোমেলের হতদরিদ্র পরিবার তার এমন দশার কথা জানার পর উপায় না পেয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) নরসিংদী জেলা কার্যালয়ে যোগাযোগ করে। অনুসন্ধানে নেমে দালাল চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। ফিরিয়ে আনা হয় রোমেলকে। মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়া রোমেলকে উদ্ধারের বর্ণনা তুলে ধরে মঙ্গলবার (৪ জুন) সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মো. এনায়েত হোসেন মান্নান।

পিবিআইয়ের এ কর্মকর্তা জানান, রোমেলকে ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই-মিসর হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। সেখানে নিয়ে তাকে আটকে রেখে স্বজনদের ভিডিও কলে রেখে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। ১০ এপ্রিল রোমেলের ভাই বাবুল ও তার স্বজনরা পিবিআই কার্যালয়ে এসে বিষয়টি জানান। টাকা না পাঠালে রোমেলকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ঘটনাটি পুলিশকে জানালে রোমেলকে হত্যা করা হবে বলে জানায় চক্রের সদস্যরা।

অভিযোগের ভিত্তিতে পিবিআইয়ের তৎপরতা গোপন রেখে জিম্মিকারীদের দেওয়া চারটি বিকাশ নম্বরে দেড় লাখ টাকা পাঠানো হয়। চক্রটি টাকা গ্রহণ করে আরও টাকা পাঠাতে তাগাদা দেয়। একপর্যায়ে পিবিআইয়ের তিনটি টিম একযোগে ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের ভৈরব এবং নরসিংদীর রায়পুরা থানা এলাকায় অভিযান চালায়। ওই সময় ওয়াসিম হোসেন ও আকারিছ মিয়া নামে চক্রটির দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৯টি মোবাইল ফোন, মুক্তিপণের দেড় লাখ টাকা ও বিকাশের জন্য ব্যবহৃতসহ ২২টি সিমকার্ড উদ্ধার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যে চক্রের হোতা সোহেলকেও ধরা হয়।

এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, পিবিআইয়ের কাছে তথ্য ছিল যে জিম্মিকারীদের হোতা সোহেল বাংলাদেশে রয়েছে। সে যাতে পালাতে না পারে সেজন্য সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে চিঠি দেওয়া হয়। ১৯ এপ্রিল সোহেল দেশ থেকে দুবাই পালিয়ে যেতে শাহজালাল বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে। পরে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সোহেল রিমান্ডে অনেক তথ্য দেয়।

পিবিআইয়ের তৎপরতায় সোহেলের মোবাইল ফোন দিয়ে লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার পর রোমেলকে ছাড়তে রাজি হয় জিম্মিকারীরা। অনেক নাটকীয়তার পর সোহেলের কথামতো রোমেলকে একদিন ঘুরিয়ে রাত ৩টায় ত্রিপোলিতে রহমত উল্লাহ নামে এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়। কিন্তু রোমেলকে ত্রিপোলি থেকে দেশে আনার জন্য পাসপোর্ট, ভিসা ও বিমান টিকিটের জটিলতা দেখা দেয়।

পিবিআই কর্মকর্তারা লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে একাধিকবার কথা বলে অনেক চেষ্টার পর ২৪ মে রোমেলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। তাকে যেখানে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল সেখানে আরও ১১ বাংলাদেশিকে জিম্মি অবস্থায় দেখেছেন বলে জানান রোমেল।

সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী রোমেল বলেন, বিল্লাল ও রহমতউল্লাহ তাকে ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই থেকে মিসর হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। সেখানে দিনের পর দিন রেখে তাকে নির্যাতন করা হয়। বাড়ির লোকজনকে ভিডিও কলে রেখে মারধর করে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তাকে যে কক্ষে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল সেখানে আরও কয়েকজন বাংলাদেশি ছিল। যাদের একইভাবে চাকরি দেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করে মানব পাচারকারী চক্র। যে ঘরে তাদের জিম্মি করে নির্যাতন করা হয়েছিল সেখানে একজন দলনেতা ছিল যাকে সবাই ‘বেয়াই’ বলে ডাকত।

এ ছাড়া দেলোয়ার, আরিফ, রুহুল, তানভীর, সাইফুল, আবুল, হৃদয় খান ও তানভীর নামে আরও কয়েকজন ছিল। তারা বলত, ‘১২ লাখ টাকা দিবি, নয়তো মেরে ফেলব।’ তারা বারবার টাকা দেওয়ার জন্য তাড়া দিত, সময় দিতে রাজি ছিল না।

তারা বলত, ‘তোর মতো অনেক রোমেল হারিয়ে গেছে, তোকেও মেরে ফেলব।’

এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে রোমেল বলেন, কোনো সময় কল্পনা করিনি বাংলাদেশের মুখ দেখব। আমি ফিরে আসতে পারছি এজন্য পিবিআইকে ধন্যবাদ।

রোমেলের বাবা আসাদ বলেন, যখন আমার ছেলে যায় তখন রমজান মাস ছিল। আমরা গরিব মানুষ, ভিটা বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম, পরে আবার টাকা চায় কিন্তু আমরা কোথা থেকে টাকা দেব। ছেলে ফিরে আসছে এজন্য আমি খুশি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *